☆☆ মহান মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠ ☆☆
📝 জ্ঞানের আলো
বীরশ্রেষ্ঠ বীরত্বের জন্য প্রদত্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক। যুদ্ধক্ষেত্রে অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের নিদর্শন স্থাপনকারী যোদ্ধার স্বীকৃতিস্বরূপ এই পদক দেয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য সাত জন মুক্তিযোদ্ধাকে বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে ঘোষণা করেন।
এই সাতজন বীরশ্রেষ্ঠদের পরিচিতি নিয়েই আমাদের এই বিশেষ আয়োজন ।
☞ বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল
» জন্মঃ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৪৭ সালে।
» জন্মস্থানঃ ভোলা জেলার পশ্চিম হাজিপুর থানার দৌলতখান গ্রামে।
» কর্মস্থলঃ সেনাবাহিনী৷
» যোগদানঃ ১৯৬৮ সাল৷
» মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টরঃ ৮ নং সেক্টর৷
» মৃত্যুঃ ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল৷
» সমাধি স্থলঃ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার দরুইন গ্রামে৷
বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ভোলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন৷ তাঁর পিতা হাবিবুর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন হাবিলদার৷ তিনি স্বপরিবারে কুমিল্লা সেনানিবাসে থাকতেন৷ ছোটবেলা থেকেই মোস্তফা কামালের স্বপ্ন ছিল সৈনিক হওয়ার। তাই পারিবারিক অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি ২০ বছরবয়সে বাড়ি থেকে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান। চুপিচুপি যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে৷
তিনি ১৯৬৭ সালে সাধারণ সৈন্য হিসেবে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়কর্মরত ছিলেন। ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে তিনি আখাউড়ার দরুইন গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এ যুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি বীরোচিত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। নিজের জীবনের বিনিময়ে সহযোদ্ধাদের জীবন বাঁচিয়েছিলেন এ বীর সৈনিক।
☞ বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান
» জন্মঃ ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩ সালে।
» জন্মস্থানঃ ২৪ পরগনা জেলা, পশ্চিমবঙ্গ জন্মগ্রহণ করেন।
» কর্মস্থলঃ সেনাবাহিনী৷
» যোগদানঃ ১৯৬৮ সাল৷
» মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টরঃ ৪নং সেক্টর ৷
» মৃত্যুঃ ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল৷
» সমাধি স্থলঃ মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ৷
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান ১৯৫৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তাঁর পরিবার পূর্ববঙ্গে চলে আসে এবং খুলনা জেলার খালিশপুরের খোরদা নামক স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
১৯৭১ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী তিনি ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে সিপাহী হিসাবে যোগ দেন। অক্টোবর মাসে তিনি ধলই সীমান্তের ফাঁড়ি দখল করার অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। এ অভিযান চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর এলএমজির গুলির ফলে প্রবল বাধার সম্মুখীন হন। হামিদুর রহমান নিঃশব্দে ক্রোলিং করে দুজন এলএমজি অপারেটরকে হত্যা করেন এবং শত্রুদের থামিয়ে দেন। এসময় তিনি বুলেটের আঘাতে শহীদ হন।
☞ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর
» জন্মঃ ৮ই মার্চ,১৯৪৯ সালে।
» জন্মস্থানঃ বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানার রহিমগঞ্জ গ্রামে৷
» কর্মস্থলঃ সেনাবাহিনী৷
» যোগদানঃ ১৯৬৭ সাল৷
» মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টরঃ ৭নং সেক্টর ৷
» মৃত্যুঃ ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল।
» সমাধি স্থলঃ চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণ ৷
বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ছাত্র হিসেবে বেশ মেধাবী ছিলেন ৷ লেনিন, মাও-সেতুং, চে গুয়েভারা মতো ব্যক্তির সংগ্রামী জীবনের গল্প ও রাজনৈতিক দর্শন তাঁকে ছাত্রজীবন থেকেই অনুপ্রাণিত করেছিল। ৷ আইএসসি পাস করে ১৯৬৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই ১৯৬৭ সালে তিনি পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের ১৭৩ নং ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিলেন। ৩ জুলাই তিনি নিজ স্টেশন থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যোগদান করেন। তিনি ডিসেম্বর মাসে ৭ নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর অধনায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৪ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করার জন্য চূড়ান্ত অপারেশন শুরু হয়৷ এই অভিযানেই ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর শত্রুর গুলিতে শহীদ হন।
☞ বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আবদুর রউফ
» জন্মঃ ১ মে, ১৯৪৯ সালে।
» জন্মস্থানঃ ফরিদপুর জেলার মধুখালী থানার সালামতপুর গ্রামে৷
» কর্মস্থলঃ ই পি আর ( ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)৷
» যোগদানঃ ৮ মে ১৯৬৩ সাল৷
» মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টরঃ ১নং সেক্টর ৷
» মৃত্যুঃ ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল ৷
» সমাধি স্থলঃ রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারের পাশে ৷
২০ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে রাঙামাটি ও মহালছড়ির সংযোগপথ বুড়িঘাট এলাকায় চিংড়ি খালের দুইপাশে নির্মিত প্রতিরক্ষা ব্যুহ অক্ষুন্ন রাখতে গিয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচন্ড যুদ্ধে অবর্তীণ হয়েছিলেন। এসময় পলায়নরত পাকবাহিনীর গুলিতে তিনি শহীদ হন।
☞ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান
» জন্মঃ ২৯ অক্টোবর, ১৯৪১ সাল।
» জন্মস্থানঃ নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামে৷
» কর্মস্থলঃ বিমানবাহিনী৷
» যোগদানঃ ১৯৬৩ সাল৷
» মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টরঃ পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন।
» মৃত্যুঃ ২০ আগস্ট, ১৯৭১ সাল।
» সমাধি স্থলঃ মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান।
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধ আরম্ভ হবার পর তিনি মুক্তিযোদ্ধাদেরযুদ্ধ বিমান দিয়ে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর মাশরুর ঘাটি থেকে “ব্লু বার্ড” নামে ১টি টি-৩৩ যুদ্ধ বিমান ছিনিয়ে নেন এবং বাংলাদেশের পথে রওনা দেন। কিন্তু ভারতীয় সীমান্তে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে তিনি শহীদ হন।
☞ বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্সনায়ক নূর মোহাম্মদ শেখ
» জন্মঃ ২৬ এপ্রিল, ১৯৩৬ সালে।
» জন্মস্থানঃ নড়াইল জেলার মহেশখোলা গ্রামে৷
» কর্মস্থলঃ ই.পি.আর. (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)
» যোগদানঃ ১৯৫৯ সালে।
» মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টরঃ ৮নং সেক্টর ৷
» মৃত্যুঃ ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল।
» সমাধি স্থলঃ যশোরের গোয়ালহাটিতে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ৮ নম্বর সেক্টরের স্থায়ী টহলে নিযুক্ত ছিলেন। ৫ সেপ্টেম্বর পাক হানাদারবাহিনী কর্তৃক ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে পড়েন। এসময় সঙ্গীদের বাঁচানোর জন্য তিনি একাই পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিলেন। শেষে সঙ্গীরা পালিয়ে জীবন বাঁচাতে সক্ষম হলেও বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ হানাদারবাহিনীর গুলিতে নিহত হন।
☞ বীরশ্রেষ্ঠ স্কোয়াড্রন লিডার রুহুল আমিন
» জন্মঃ ১৯৩৪ সালে।
» জন্মস্থানঃ নোয়াখালি জেলার বেগমগঞ্জ থানার গ্রামে৷
» কর্মস্থলঃ সেনাবাহিনী৷
» যোগদানঃ ১৯৫৩ সাল৷
» মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টরঃ ১০নং সেক্টর ৷
» মৃত্যুঃ ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল।
» সমাধি স্থলঃ রূপসা নদীর তীরে। (খুলনা)
১৯৫৩ সালে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন একজন জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি নবগঠিত বাংলাদেশ নেভিতে চিফ আর্টিফিসিয়ার হিসেবে পলাশ গানবোটে যোগ দেন। ১০ ডিসেম্বর তিনি নৌবাহিনীর জাহাজ বিএনএস পদ্মার স্কোয়াড্রন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। এসময় হানাদারবাহিনীর হামলায় জাহাজের ইঞ্জিনে আগুন লেগে যাওয়ায় তিনি আহত হন। রুহুল আমিন মারাত্মক আহত অবস্থায় নদীতে ঝাঁপ দেন কিন্তু সাঁতরে নদীর তীরে পৌছানোর পর রুহুল আমিনকে রাজাকারেরা ধরে ফেলে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
0 Comments